
বিপ্লব কান্তি নাথঃ
চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার বরমা ইউনিয়নের বাইনজুড়ী গ্রামের পৌষ মাসের শেষদিন অর্থাৎ পৌষ সংক্রান্তিতে শ্রীশ্রী শুক্লাম্বর দিঘীর পূন্যস্নান ও বাৎসরিক মেলা আগামী ১৪ই জানুয়ারি ২০২৫ ইংরাজি ২৯ পৌষ ১৪৩১ বাংলা রোজ মঙ্গলবার। প্রতি বছরের ন্যায় এবছরও ব্যাপক উৎসাহ উদ্দিপনায় অনুষ্ঠিত হবে। বিশাল দীঘির চার পাড়ে ভক্তরা মনোবাসনা পূরণে হাজার হাজার নারী-পুরুষ স্নান, কবুতর উড়িয়ে দেওয়া, দীঘির জলে দুধ ও ডাবের পানি ঢালেদেওয়া, পূজা-অর্চনা, মন্দির সংলগ্ন অশ্বত্থ গাছে রঙিন সুতো বেঁধে মনোবাসনা পূরণের আশায়। হাজার হাজার পুর্ণ্যার্থীর উপস্থিতিতে সরগরম হয়ে ওঠেবে এই মেলা। মেলা একদিন হলেও আগের দিন বিকেল হতে পূণ্যার্থী, তীর্থযাত্রী, দোকানী ও পূজারীদের আগমন ঘটে।শ্রীশ্রী শুক্লাম্বরদিঘী সম্পর্কে নৃপেন্দু দত্ত’র ভাষ্যমতে, চন্দনাইশ থানার দক্ষিণে শঙ্খনদীর তীরবর্তী বাইনজুরি মৌজার সুচিয়া গ্রামে শ্রী শুক্লাম্বর ভট্টাচার্য্যের শ্রীপাট। ত্রিপুরা সুন্দরী দেবীর মন্দির দীঘি ও আশেপাশের বিশাল জায়গা নিয়ে এ শ্রী পাটের পত্তন হয় প্রায় পাঁচশো বছর আগে ষোড়শ শতকের প্রথম দিকে নবদ্বীপ থেকে শ্রী শুক্লাম্বর ভট্টাচার্য্য এখানে এসেছিলেন। তিনি ছিলেন বৈদিক শ্রেণীর ব্রাহ্মণ। তাঁর পূর্ব পুরুষেরা মিথিলা থেকে এসে প্রথমে সিলেটের পঞ্চখণ্ডে বসতি স্থাপন করেছিলেন। কিন্তু তাঁরা চিরকাল সেখানে ছিলেন না। বিদ্যার্জনের জন্য তাঁরা নবদ্বীপ চলে গিয়েছিলেন। বিদ্যা ও জ্ঞানের জন্য তখন প্রসিদ্ধ ছিল নবদ্বীপ। শ্রী শুক্লাম্বর ভট্টাচারয্যের ছিল একান্নবর্তী বৃহৎ পরিবার। তর্কবাগীশ ও সিদ্ধান্ত বাগীশ নামে পণ্ডিত দু’ভাই এবং তাঁদের নিকট পরিজনেরা। তিন ভাইয়ের মধ্যে শ্রী শুক্লাম্বর ভট্টাচার্য ছিলেন বড়। তিঁনি সঙ্গতিপন্ন ছিলেন। তাই এখানে একলা কিংবা সঙ্গোপনে আসতে পারেননি। পথ দুর্গম হলেও তিঁনি সপরিবারে রাজার মতো এসেছিলেন। তবে নবদ্বীপ থেকে তাঁর এতখানি অধ্যবসায় সাপেক্ষে এতদূর আসার পিছনে হয়তো ধর্মবিপ্লবই ছিল প্রধান কারণ। নবদ্বীপে তখন শাক্ত-বৈষ্ণব ধর্মের দ্বন্দ্ব প্রবল। শ্রী শুক্লাম্বর ভট্টাচার্য ছিলেন মাতৃভাবনার সাধক। হয়তো সাধনার জন্য বিবাদ, বিপদ, বিশৃঙ্খলা ও বিপর্যয়ের পথ পরিহার করে তিনি এ প্রত্যন্ত প্রদেশে সরে এসেছিলেন। একান্নবর্তী পরিবারের কর্তা হলেও তাঁর মধ্যে ছিল এক গভীর নিরাসক্তি। বিবেক, বৈরাগ্য ও ভক্তি তাঁকে সংসারে সন্যাসী করে তুলেছিল। তিঁনি ছিলেন শক্তি উপাসক। অষ্টাদশ মহাবিদ্যার অন্তর্গত ত্রিপুরা সুন্দরী ছিলেন তাঁর ইষ্টদেবী। সুচিয়া গ্রামে এসে বসতি স্থাপনের প্রায় সঙ্গে সঙ্গে তিঁনি খনন করিয়েছিলেন একবড় দীঘি। দীঘির পাড়ে অশ্বত্থ বট আর পাকুড়ের ছায়ায় তিঁনি ইষ্টদেবীর জন্য একটি ছোট মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। আর মন্দিরের অদূরে তৈরি করেছিলেন তাঁর সাধন মঠ। এ মঠে তিঁনি সিদ্ধিলাভ করেছিলেন। কথিত আছে এ মঠেই দেবী ত্রিপুরা সুন্দরী সাক্ষাৎ আবির্ভূত হয়ে তাঁকে সাধনার সিদ্ধিফল প্রদান করেছিলেন। উত্তরায়ণ সংক্রান্তিতে এ দীঘিতে স্নান করলে গঙ্গাস্নানের ফল হয়। যে শঙ্খ নদীর অববাহিকায় এ দীঘির অবস্থান তার প্লাবনের জলও কখনো প্রবেশ করেনি। অবশ্য এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে একটি কিংবদন্তী। কাহিনীটি এ রকম শ্রাবণের কোন এক ঘন বর্ষণের ভোরে খর স্রোতা প্রলয়ঙ্করী শঙ্খনদী এ দিঘীতে ঢুকবে পণ করে প্রবল বেগে আছড়ে পড়ে ছিল পাড়ে। মঠের ধ্যানাসনে উপবিষ্ট শ্রী শুক্লাম্বর হাতে কমন্ডলুটি নিয়ে এসে দাঁড়িয়ে ছিলেন এ প্রবল স্রোতের মুখে। তিঁনি দীঘির জল অপবিত্র হবে ভেবে নদীকে ফিরে যেতে অনুরোধ করেছিলেন। নদীর জল দীঘিতে ঢুকলে দীঘির জল অপবিত্র হওয়ার আশঙ্কা ছিল। কারণ নদীর স্রোতে ভেসে এসেছিল একটি মরা গরু। ইষ্টদেবতাকে স্মরণ করে এ সাধক হাতের কমন্ডলুর জল ছিটিয়ে দিয়ে বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন মরা গরুটি। প্রাণ পেয়ে সেইটি গিয়ে দাঁড়িয়েছিল উঁচু ডাঙায়। মুহূর্তে স্থির হয়ে গিয়েছিল উমত্ত জলরাশি। জল থেকে উঠে এসেছিলেন মকর বাহনা গঙ্গা। তিঁনি বর দিয়েছিলেন যে শঙ্খ নদীর জল কোনদিন দীঘিতে প্রবেশকরবে না। শ্রী শুক্লাম্বরের এ অলৌকিক লীলা প্রত্যক্ষ করেছিলেন যোশীরাম। যোশীরাম তাঁর সেবক। ছায়ার মতো নিত্যসঙ্গী। যোশীরাম এ লীলা প্রত্যক্ষ করে ধন্য হয়েছিলেন। তিঁনিই তা প্রচার করেছিলেন। এ যোশীরাম মনে হয় বাঙালি ছিলেন না। দীর্ঘদিন তাঁর প্রভুর সঙ্গে থেকে এদেশীয় সবকিছু আয়ত্ত করেছিলেন। তাই দূর-দূরান্তের দেশ-বিদেশের ভক্তেরা সারা বছর আসেন। সবচেয়ে বেশি সমাগম হয় উত্তরায়ণ সংক্রান্তির সময় শুনা যায় এই দিনে তিনি সিদ্ধি লাভ করেছিলেন এবং এই পবিত্র দিনে তিনি লোকচক্ষুর আড়া হয়। তাই এই পবিত্র দিনকে চির স্মরনীয় করে রাখতে এই মেলার আয়োজন করেন, এ মেলাটি প্রাচীন। শ্রী শুক্লাম্বরের অমর্ত্য জীবন লীলা যে পুঁথিতে লিপিবদ্ধ ছিল বলে জানা যায় তার নাম ‘ শুক্লাম্বর-তরঙ্গিনী। শ্রী শুক্লাম্বরের ভক্ত ও অনুরাগী নিত্যানন্দ বৈদ্য নামে একজন এপুঁথির কোন কোন অংশ নাকি গান করে শোনাতেন। বোঝা যায় এ সাধকের জীবন কথা ও নানা কাহিনী এ ভাবে ক্রমে ক্রমে লোকমুখে প্রচারিত হয়েছে। শ্রী শুক্লাম্বরের কোন সমাধি নেই। কারণ তিনি অষ্ট সিদ্ধি লাভ করেছিলেন বলে, তিনি লোকচক্ষুর আড়াল হয়েছেন, তিনি সদা জাগ্রত। ভক্তের ভক্তি অহৈতুকী। তাই ভক্তের বিশ্বাস সম্মানযোগ্য। এ তীর্থক্ষেত্রের সবখানে ভগবান শুক্লাম্বরের চরণ পাতা রয়েছে ভক্তেরা মনে করেন।
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত শুক্লাম্বর দীঘি :
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে বাইনজুরী গ্রামে হিন্দু সম্প্রদায়ের অসংখ্য বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। ঘরহীন, নিরন্ন, অসহায় মানুষ তখন আশ্রয় নেয় দীঘির পাড়ে এবং অশ্বত্থের তলায় সেই মন্দিরে। তবে পরবর্তীতে মুক্তিযোদ্ধারা সেই দীঘির পাড়ে ঘাঁটি গড়ে তুলে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় কয়েক’শ মুসলিম তরুণ-যুবক পাহারা দিয়ে এই মন্দির রক্ষা করেছে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী, রাজাকার-আলবদররা গ্রামে এলেও মন্দিরে ঢুকতে পারেনি। মুক্তিযোদ্ধারা এই দীঘির পাড়ে অবস্থান নিয়েছিলাম। এই পুকুরের পাড় থেকেই বিভিন্ন অপারেশন পরিচালনা করেছিলেন বলে অনেক মুক্তিযোদ্ধারা তাদের প্রকাশিত বইতে লিখেছেন।
এই উৎসব হিন্দু ধর্মের হলেও এটা ধর্মের আবরণে সীমাবদ্ধ নেই। এটা সব ধর্মের মানুষের অসাম্প্রদায়িক একটা উৎসবে পরিণত হয়েছে। এই জনপদ যাত্রা মোহন সেন, যতীন্দ্র মোহন সেন আর মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীদের জনপদ। এখানে সাম্প্রদায়িকতার কোন ঠাঁই নেই। সেজন্য পৌষ সংক্রান্তির এই মেলা সার্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে।
