৬ই জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

সনাতন শাস্ত্রে গ্রহণের কারণ ও ব্যাখ্যা!

নিউজ ডেক্সঃ

আজ চন্দ্রগ্রহণ। “গ্রহণ” নিয়ে সেই প্রাচীনকাল থেকেই মানুষের বিস্ময়ের শেষ নেই। সমস্ত প্রাচীন সভ্যতায় গ্রহণ নিয়ে মজার মজার কাহিনীও প্রচলিত রয়েছে।যাইহোক! সেই প্রাচীনকাল থেকেই গ্রহণের সত্যিকার কারণ সম্পর্কে অবহিত ছিলেন ভারতীয় ঋষিগণ। তারই প্রমাণ আমরা দেখতে পাই ঋগ্বেদের শাকল সংহিতার পঞ্চম মণ্ডলের চল্লিশতম সুক্তের পাঁচ নম্বর (৫/৪০/৫) মন্ত্রে।

“Svarbhānu: is a name of rāhu, the person nified ascending node, the causer of an eclipse; he was a son of kaśyapa, by Danu, the mother of the Dānavas or asuras; another genitive alogy makes him the son of Vipraciti, by Siṃhikā, the sister of Hiraṇyakaśipu”

এখন বেদের এই গূঢ়তত্ত্ব স্পষ্ট বোঝার জন্য যা পাঠ করা আবশ্যক সেই পুরাণ শাস্ত্রে গ্রহণের কারণ নিয়ে কী বলছে তা জানা যাক! তবে গ্রহণ সম্পর্কে জানার আগে গ্রহণ সম্পর্কিত বেশ কিছু তথ্য আমাদের জানতে হবে। অমাবস্যা, পূর্ণিমা কেন হয়?অমাবস্যা ও পূর্ণিমা কেন হয় তা আমাদের জানা আবশ্যক। কারণ অমাবস্যা ব্যতীত সূর্যগ্রহণ এবং পূর্ণিমা ব্যতীত চন্দ্র গ্রহণ হয় না। এই অমাবস্যা ও পূর্ণিমার কারণও আমরা পুরাণ শাস্ত্র থেকেই জানবো। দেখা যাক! অমাবস্যা, পূর্ণিমায় পৃথিবীর সাপেক্ষে সূর্য, চন্দ্রের অবস্থান কীরুপ হয়?অমাবস্যা, পূর্ণিমায় সূর্য ও চন্দ্র জ্যোতিশ্চক্রের অনুবর্তী হন।”(লিঙ্গ পুরাণ, ৫৭তম অধ্যায়)পৃথিবীর আকাশে সূর্য, চন্দ্র ও সৌরজগতের গ্রহগুলোর অবস্থান জানার জন্য পৃথিবীর থেকে দৃশ্যমান আপাত স্থির তারকামণ্ডলকে নিয়ে জ্যোতির্বিজ্ঞানের জ্যোতিশ্চক্র তথা রাশিচক্র ও নক্ষত্রের সাহায্য নেওয়া হয়। সূর্য ও চন্দ্র যখন রাশিচক্রে পৃথিবীর সাপেক্ষে একই রাশি, একই নক্ষত্রে অবস্থান করে তখন অমাবস্যা এবং দুজনে যখন পরস্পরের বিপরীত রাশি, বিপরীত নক্ষত্রে অবস্থান করে তখন পূর্ণিমা হয়ে থাকে। অমাবস্যা ও পূর্ণিমায় সূর্য ও চন্দ্র একই সরলরেখায় অবস্থান করে, তাই লিঙ্গ পুরাণের পূর্বভাগের ৫৭তম অধ্যায়ে বলা হয়েছে, “অমাবস্যা, পূর্ণিমায় সূর্য ও চন্দ্র জ্যোতিশ্চক্রের অনুবর্তী হন। সূর্য, চন্দ্র বিষুব সংক্রান্তিতে সমানকালে উদিত ও সমান কালে অস্তগত হন।”সূর্য, চন্দ্র পৃথিবীর সাপেক্ষে বিষুবতে অর্থাৎ একই রাশি, একই নক্ষত্রে অবস্থান করলে তাদের উদয়াস্ত একই সময় হয়ে থাকে। আমরা জানি, পৃথিবীর একমাত্র উপগ্রহ হলো চন্দ্র। পৃথিবী যেমন সূর্যের আলোয় আলোকিত হয় তেমনি চন্দ্রও সূর্যের আলোতেই আলোকিত হয়। আমাদের পৃথিবী নিজের অক্ষের চারদিকে ঘুরতে ঘুরতে সূর্যের চারদিকে ঘুরে চলেছে। চাঁদও প্রতিনিয়ত পৃথিবীর চারদিকে ঘুরছে।এমতাবস্থায়, চাঁদ অমাবস্যার সময় সূর্য ও পৃথিবীর মাঝখানে একই সরলরেখায় চলে আসে, তখন পৃথিবীর দিকে মুখ করা চন্দ্রপৃষ্ঠে (পৃথিবীর থেকে চাঁদের কেবল একটি পৃষ্ঠ দেখা যায়।) সূর্যের আলো পৌঁছায় না, সূর্যোলোকের অনুপস্থিতিতে তখন ওই চন্দ্র পৃষ্ঠে রাত্রি বিরাজ করে। তাই বিষ্ণু পুরাণে বলা হয়েছে, “অমাবস্যার সময় চন্দ্র সূর্যের অমা রশ্মিতে বসবাস করেন।” সূর্যবিহীন যে অন্ধকার তাই হলো সূর্যের অমা অর্থাৎ অন্ধকার রশ্মি। অমাবস্যায় চন্দ্রপৃষ্ঠে সেই অমা বিরাজ করে। চন্দ্র ওইদিন অমা রশ্মিতে বাস করেন বলে ওই তিথির নাম অমাবস্যা। আর পূর্ণিমার সময় চন্দ্র পৃথিবীকে মাঝখানে রেখে সূর্যের বিপরীতে এক সরলরেখা বরাবর অবস্থান করে। এইসময় চন্দ্রের পূর্ণ মণ্ডল দৃষ্ট হয় বলে ওই তিথির নাম পূর্ণিমা।ভূ-কক্ষের সাপেক্ষে চন্দ্রমার্গের অবস্থান চিত্র ও প্রতি পূর্ণিমা, অমাবস্যায় গ্রহণ না হওয়ার কারণ:প্রতি অমাবস্যা, পূর্ণিমায় সূর্য, চন্দ্র, পৃথিবী যদি এক সরলরেখা বরাবর চলে আসে তাহলে সব অমাবস্যা পূর্ণিমায় গ্রহণ হয় না কেন? কারণ চন্দ্র পৃথিবীর চারিদিকে ভূ-কক্ষ বরাবর ভ্রমণ করে না। তার ভ্রমণ পথটি ভূ-কক্ষের সাথে ৫ degree decline অবস্থায় রয়েছে। এই কারণে দেখা যায় অধিকাংশ পূর্ণিমা অমাবস্যায় চাঁদের অবস্থান চন্দ্রমার্গের ও ভূ-কক্ষের মিলিত বিন্দু (যা পুরাণে রাহু নামে পরিচিত) থেকে উপরে না হয় নীচের দিকে হয়। চন্দ্রমার্গ যে পৃথিবীর কক্ষের সাপেক্ষে এইরূপে অবস্থান করছে তার উল্লেখ আমরা লিঙ্গ পুরাণের পূর্বভাগের ৫৭তম অধ্যায়ে পাব।”চন্দ্র পর্বে উত্তরায়ণ মার্গস্থিত হলে উচ্চতাবশত শীঘ্রই দৃষ্ট হন, আর দক্ষিনায়ণ মার্গস্থিত হলে নীচ পৃথিবীকে আশ্রয় করেন। নিশাকর অমাবস্যায় উত্তরমার্গে অবস্থান করেন, দক্ষিণমার্গেও অল্পরুপে দৃষ্ট হন, বিশেষ রুপে নয়। সূর্য দক্ষিণ মার্গে চলেন বলে গ্রহণের আধোদেশ প্রসারিত হয়।”তাহলে দেখা যাচ্ছে, প্রতি অমাবস্যায় সূর্য ও চন্দ্র বিষুব ক্ষেত্রে অর্থাৎ একই রাশি, একই নক্ষত্রে অবস্থান করলেও সূর্য চন্দ্রের নিম্নগামী হয়ে চলার দরুন একই সমতলে আসে না বলে গ্রহণ হয় না, যা পুরাণে পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে।সূর্যগ্রহণ হোক বা চন্দ্রগ্রহণ, উভয়ক্ষেত্রেই চন্দ্রই রাহু কর্তৃক গৃহীত হন:সূর্যগ্রহণ বা চন্দ্রগ্রহণ কালে রাহু কর্তৃক চন্দ্রই গৃহীত হন অর্থাৎ চন্দ্র রাহু যুক্ত হন। এখন রাহু বলতে কেবলই একটি অসুর বুঝতে হবে তা কিন্তু নয় (অবশ্য মহাজাগতিক রাহু স্থানের অধিপতি অবশ্য রয়েছেন, তার নাম স্বর্ভানু) মহাজাগতিক রাহু কে তার ব্যাখ্যা পুরাণেই দেওয়া হয়েছে।ব্রহ্মাণ্ড পুরাণের ৫৮তম অধ্যায়ের ৫৩ থেকে ৬৬ নম্বর শ্লোকে বলা হয়েছে,

“পৃথিবীর উর্ধ্বগত মণ্ডলাকার ছায়াই হলো রাহু। রাহুর স্থান বৃহৎ ও তমোময়। এই স্থান অমাবস্যায় চন্দ্রের থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে সূর্যে প্রবেশ করে, পূর্ণিমায় সূর্যের থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে চন্দ্রে প্রবেশ করে।”অর্থাৎ পূর্ণিমায় সূর্য কর্তৃক উৎপাদিত পৃথিবীর ছায়া পৃথিবীর থেকে বিস্তৃত হয়ে চন্দ্রকে গ্রাস করে বলে চন্দ্রগ্রহণ হয়। আবার অন্যদিকে অমাবস্যায় চন্দ্রের ছায়া পৃথিবীর থেকে বিস্তৃত হয়ে সূর্য মন্ডলেই প্রবেশ করে বলে অমাবস্যায় সূর্যগ্রহণ হয়।তবে গ্রহণের পুরো ব্যাপারটা অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে বর্ণনা করা হয়েছে দেবী পুরাণে। দেবী পুরাণের উনপঞ্চাশতম অধ্যায় জুড়ে গ্রহণ সম্পর্কে বিস্তৃত ধারণা দেওয়া হয়েছে।দেবী পুরাণের উনপঞ্চাশতম অধ্যায়ের ১-৩ নম্বর শ্লোকে বলা হয়েছে,”লোকেরা মূঢ়তা প্রযুক্ত হয়ে ভাবে রাহু সূর্য, চন্দ্রকে গ্রাস করে। যদি তাই হয় তাহলে তেজময় দিবাকরকে গ্রাস করলে রাহুর উদর ভস্মীভূত হয় না কেন? রাহু শত্রু দিবাকরকে যদি মুখে দংশন করে তাহলে সূর্য খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে যায় না কেন? সূর্য মুক্ত হলে তাঁকে তেমনই অখণ্ড দেখায় কেন?”তারপর দেবী পুরাণে অত্যন্ত সুন্দরভাবেই ব্যাখ্যা করা হয়েছে, রাহু মোটেও সূর্যকে আক্রমণ করে না। তবে পুরাণের বর্ণনা মতে, চন্দ্র সূর্যালোকের দ্বারা শুক্লপক্ষে বর্ধিত হতে থাকে ও তার গর্ভে অমৃত সঞ্চিত হয়। কৃষ্ণপক্ষ এলে দেবগণ নিজ নিজ ভাগের অমৃত পান করে। ব্রহ্মা রাহুর জন্যও চন্দ্রের অমৃতের ভাগ নির্দিষ্ট করেছেন।এরপর ৮ থেকে ৯ শ্লোকে বলা হয়েছে,”রাহু পর্বে পর্বে পৃথিবীর ছায়া গ্রহণ করে চন্দ্রকে আচ্ছাদন করে অমৃত পানের উদ্দেশ্যে। পূর্ণিমায় চন্দ্রের নিকট উপস্থিত হয়। অমাবস্যায় সূর্য মণ্ডলে প্রবেশ করে। সূর্য মণ্ডলেও উপস্থিত হয় চন্দ্রের থেকে অমৃত পানের উদ্দেশ্যে।তারপর ১৯-২৬ নম্বর শ্লোকে বলা হয়েছে,”সূর্য দেবগণের পিতৃস্বরুপ, চন্দ্র দেবগণের মাতৃস্বরুপ। . . . সূর্য প্রমাণে তিথির অংশ (সন্ধিক্ষণ) যতটুকু পর্বচ্ছায়ার সময়কাল ততটুকু। রাহু চন্দ্রকে আবরণ করে অতএব রাহু অপেক্ষা চন্দ্র উপরে, চন্দ্রের উর্ধ্বে দিবাকর, পর্বকালে এইরুপ অবস্থান হয়। রাহুকে নিয়ে চন্দ্র এইকারণে মেঘের ন্যায় সূর্যকে আড়াল করে। রাহু পৃথিবীর ছায়া উদ্ধৃত করিয়া ধুম্রবর্ণের মেঘের মতো চন্দ্রকে আচ্ছাদন করে।”এইখানে সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণের কারণ জানা গেল, যা বৈজ্ঞানিকভাবে সত্য। এখন রাহু কর্তৃক চন্দ্রের অমৃত পানের ব্যাপারটা অনেকের মনে সংশয় আনতে পারে। তাদের বলবো রাহু হলো পৃথিবী ও চন্দ্রের কক্ষপথের ছেদ বিন্দু তা তো পুরাণ বলেছে। তবে এই স্থানেরও অধিপতি রয়েছে (যেমন করে সূর্য, চন্দ্র আদি জ্যোতিষ্কের অধিপতি দেবতা রয়েছে) তিনিই হলেন রাহু। সেই রাহু কর্তৃক চন্দ্রের অমৃত পানের ব্যাপারটা পুরোপুরি আধ্যাত্মিক।

Share on facebook
Share on whatsapp
Share on twitter
Share on linkedin
Share on print

আরও পড়ুন