
নিজস্ব প্রতিবেদনঃ
দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম টানেল ‘বঙ্গবন্ধুর শেখ মুজিবুর রহমান টানেল’ উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার (২৮ অক্টোবর) বেলা পৌনে ১২টার দিকে পতেঙ্গা প্রান্তের ফলক উন্মোচনের মধ্যদিয়ে নদীর তল দেশ থেকে নির্মিত এ টানেলের উদ্বোধন করেন তিনি। পরে দোয়া ও মোনাজাতে অংশ নেন। পরে প্রধানমন্ত্রী তার গাড়িবহর নিয়ে টোল দিয়ে পতেঙ্গা প্রান্ত থেকে টানেল দিয়ে আনোয়ারা প্রান্তে পৌঁছান। আনোয়ারা প্রান্তের টোলপ্লাজায় পৌঁছে প্রধানমন্ত্রী নিজ হাতে টোল পরিশোধ করেন।শনিবার বেলা ১১ টা ৪০ মিনিটে নগরের পতেঙ্গা প্রান্তে সুইচ টিপে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের ফলক উন্মোচন করেন প্রধানমন্ত্রী। টানেলের প্রবেশমুখের ডান পাশে এই নামফলক স্থাপন করা হয়। একই ধরনের নামফলক স্থাপন করা হয়েছে চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার টানেলের টোল প্লাজা এলাকায়।২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি টানেলের খননকাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা । নির্মাণকাজ শুরুর প্রায় সাড়ে চার বছর পর টানেলের উদ্বোধন করা হলো।ফলক উন্মোচনের পর মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় উপস্থিত ছিলেন জাতীয় সংসদের উপনেতা মতিয়া চৌধুরী, আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোশাররফ হোসেন, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী হাছান মাহমুদ ও ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী।
টানেল উদ্বোধনের পর আতশবাজি পুড়িয়ে উদযাপন করা হয়। এ সময় উপস্থিত অতিথিরা করতালি দিয়ে স্বাগত জানান।
এর আগে প্রধানমন্ত্রী হেলিকপ্টারযোগে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে এসে পৌঁছান। পরে টানেলের পতেঙ্গা প্রান্তে যান। সেখানে ফলক উন্মোচনের মাধ্যমে টানেলের উদ্বোধন করেন। এরপর প্রধানমন্ত্রীকে বহনকারী গাড়িবহর টানেলের ভেতরে প্রবেশ করেন। টানেল দিয়ে প্রধানমন্ত্রী আনোয়ারা টোল প্লাজায় যান। সেখানে টোল প্রদান করেন। আর টোল প্লাজা কমপ্লেক্স ও টানেলের স্মার্ট মনিটরিং রুম পরিদর্শন করেন।
কর্ণফুলী টানেলটি চট্টগ্রাম বন্দরকে সরাসরি আনোয়ারা উপজেলার সাথে সংযুক্ত করা ছাড়াও সরাসরি কক্সবাজারকে চট্টগ্রামের সাথে সংযুক্ত করবে।দিনব্যাপী বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজনের পরিকল্পনা থাকলেও শেষ সময়ে এসে অতি সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর সফর। দুপুরে জনসভা শেষে তিনি ঢাকায় ফিরে আসবেন।বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের উদ্বোধন উপলক্ষ্যে প্রকাশিত স্মারক ডাকটিকিট, উদ্বোধনী খাম ও সিলমোহর অবমুক্ত করেছেন প্রধানমন্ত্রী।
রোববার সকাল ৬টা থেকে যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল।
প্রকল্পের এলাইনমেন্ট পতেঙ্গা প্রান্ত, চট্টগ্রাম বিমানবন্দর হতে কর্ণফুলী নদীর দুই কিলোমিটার ভাটিতে। আর টানেলের আনোয়ারা প্রান্ত আনোয়ারা উপজেলার কাফকো সার কারখানার নিকটে। এতে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে ছিল চায়না কমিউনিকেশন অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড।
দুই টিউব বিশিষ্ট চার লেনের টানেল প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় ১০ হাজার ৬৮৯ কোটি ৭১ লাখ টাকা। যার মধ্যে বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব অর্থায়ন ৪ হাজার ৬১৯ কোটি ৭০ লাখ টাকা ও চায়না এক্সিম ব্যাংকের ঋণ সহায়তা ৬ হাজার ৭০ কোটি টাকা।প্রকল্পের মোট দৈর্ঘ্য ৯ দশমিক ৩৯ কিলোমিটার হলেও মূল টানেলের দৈর্ঘ্য ৩ দশমিক ৩১৫ কিলোমিটার।
ব্রিজ-ভায়াডাক্টের দৈর্ঘ্য ৭২৭ মিটার (আনোয়ারা প্রান্তে), অ্যাপ্রোচ সড়কের দৈর্ঘ্য ৫ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার, টোল প্লাজার দৈর্ঘ্য ৭ হাজার ৬০০ বর্গমিটার, আন্ডার পাস ৬টি (আনোয়ারা প্রান্তে পাঁচটি এবং পতেঙ্গা প্রান্তে একটি), কালভার্ট ১২টি, সার্ভিস এরিয়ার ৩০টি বাংলো, একটি ভিআইপি বাংলোসহ মোটেল মেস, হেলনা সেন্টার, কনভেনশন সেন্টার, জাদুঘর, সুইমিংপুল, ব্রিজ, মসজিদ, অভ্যন্তরীণ রাস্তা রয়েছে।
টানেল নির্মাণে বাণিজ্যিক চুক্তি হয় ২০১৫ সালের ৩০ জুন। পরের বছরের ১৪ অক্টোবরে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। প্রকল্পের কার্যক্রম শুরু হয় ২০১৭ সালের ১৫ ডিসেম্বর। প্রধানমন্ত্রী টানেলের বোরিং কাজের উদ্বোধন করেন ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি।টানেল চালুর পর বাণিজ্যিক যোগাযোগ ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। টানেলকে ঘিরে দেশের নতুন অর্থনৈতিক সম্ভাবনার দুয়ার খুলবে। সেই সঙ্গে হাজারো সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে বলে প্রত্যাশা করছে সরকার।টানেল চালু হলে শুধু আনোয়ারা নয়, দক্ষিণ চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলার যোগাযোগ ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আসবে। ঢাকা-চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের মধ্যে আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠবে। এতে ভ্রমণ সময় ও খরচ হ্রাস পাবে। টানেল প্রকল্পকে ঘিরে দক্ষিণ চট্টগ্রামে ইকোনমিক জোনসহ বিশাল অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞ চলছে।চট্টগ্রামের আনোয়ারায় অবস্থিত কোরিয়ান রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চল (কেইপিজেড), বেসরকারি খাতে সবচেয়ে বড় সার কারখানা (কাফকো), চট্টগ্রাম ইউরিয়া সার কারখানা লিমিটেডে (সিইউএফএল) এবং চট্টগ্রাম বন্দর কার্যক্রম সম্প্রসারণ করা হচ্ছে।এছাড়া কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার মাতারবাড়ীতে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগে কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র, এলএনজি স্টেশনসহ বহুবিধ শিল্পকারখানা গড়ে উঠছে।অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বঙ্গবন্ধু টানেল দেশের পূর্বাঞ্চল, বিশেষ করে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর এবং ভারতের সেভেন সিস্টার্সের (উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাত রাজ্য) মধ্যে সংযোগ হিসেবে কাজ করবে। পদ্মা সেতুর মতো এ টানেলও অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে।