৭ই জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

বাঙালির শীতকালীন ঐতিহ্যের মধুময় উৎসব

গোপালগঞ্জ প্রতিনিধিঃ

পিঠা বাঙালি সংস্কৃতির এক চিরন্তন অংশ, যা শীতকালের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। হাজার বছরের ইতিহাসে পিঠা শুধু খাবার নয়, বরং এটি বাঙালির ঐতিহ্য, ভালোবাসা, এবং উৎসবের প্রতীক। অগ্রহায়ণ মাসে নতুন ধান ঘরে তোলার পর থেকেই শুরু হয় নবান্নের উৎসব। নবান্নের রেশ কাটতে না কাটতেই পৌষসংক্রান্তি আর শীতের কুয়াশা মিলে তৈরি হয় পিঠা-পার্বণের এক অনন্য পরিবেশ। মাঘ-ফাল্গুন মাসজুড়ে গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলার গ্রাম-বাংলার ঘরে ঘরে পিঠা তৈরির ধুম লেগে যায়।প্রাচীন বাংলা সাহিত্যেও পিঠার উল্লেখ পাওয়া যায়। কৃত্তিবাসী রামায়ণ, অন্নদামঙ্গল, মনসামঙ্গল, এমনকি মৈমনসিংহ গীতিকায়ও পিঠার প্রসঙ্গ উঠে এসেছে। প্রাচীন বাংলায় পিঠা কেবল মিষ্টান্ন নয়, এটি অতিথি আপ্যায়নের মাধুর্য বহন করত। বাঙালির গ্রামীণ সমাজে পিঠা-পার্বণ মানেই আত্মীয়স্বজনের মিলনমেলা। পিঠার গন্ধে ভরে উঠত গ্রামের প্রতিটি ঘর।শীতকালের সকালে কুয়াশার চাদর মুড়ি দিয়ে গাঁয়ের বধূরা চুলার পাশে বসে ব্যস্ত থাকেন পিঠা তৈরিতে। পিঠার মিষ্টি গন্ধে মুখরিত হয়ে ওঠে চারপাশ। ভাপা পিঠা, চিতই পিঠা, দুধচিতই, পাটিসাপটা, মালপোয়া, ক্ষীরকুলি, তিলকুলি—প্রতিটি পিঠার নামেই লুকিয়ে আছে বাঙালির সৃজনশীলতার পরিচয়। সবচেয়ে জনপ্রিয় হলো ভাপা পিঠা, যার মোলায়েম চালের গুঁড়ার আস্তরণে থাকে গুড় আর নারকেলের মিষ্টি স্বাদ।
খেজুরের রস দিয়ে তৈরি গুড় পিঠার স্বাদে এনে দেয় অনন্য মাধুর্য। এই রস দিয়ে তৈরি পিঠা শুধু খাবার নয়, এটি বাঙালির শীতকালীন উৎসবের কেন্দ্রবিন্দু। পিঠা-পায়েসে রসনা তৃপ্তির পাশাপাশি তৈরি হয় আত্মিক সম্পর্কের বন্ধন। বিশেষ করে জামাই আদরের অংশ হিসেবে পিঠার গুরুত্ব অপরিসীম।
শুধু কাশিয়ানী উপজেলার গ্রাম-বাংলাই নয়, গোপালগঞ্জের শহরেও পিঠার এই ঐতিহ্য সমানভাবে জনপ্রিয়। শীত এলে শহরের ফুটপাত, জনবহুল এলাকা ও টার্মিনালে ভাপা পিঠা বিক্রির ধুম পড়ে। চিতই পিঠা, পাটিসাপটা, মালপোয়া ইত্যাদির গন্ধে মেতে ওঠে শহরের অলিগলি। যদিও খোলামেলা স্থানে এসব পিঠা তৈরি ও বিক্রি কিছুটা অস্বাস্থ্যকর, তবুও শীতের পিঠার প্রতি মানুষের আকর্ষণ কমে না।
পিঠা কেবল খাবার নয়, এটি বাঙালির সংস্কৃতি ও আবেগের প্রতীক। পিঠাকে কেন্দ্র করে গ্রাম-বাংলার বিভিন্ন স্থানে প্রচলিত রয়েছে অসংখ্য গান, ছড়া ও কাহিনি। বিখ্যাত কবি বেগম সুফিয়া কামাল পিঠাকে নিয়ে লিখেছিলেন, “পৌষ পার্বণে পিঠা খেতে বসি খুশিতে বিষম খেয়ে/ আরও উল্লাস বাড়িয়াছে মনে মায়ের বকুনি পেয়ে।”শীতকালীন পিঠার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ভাপা পিঠা, দুধচিতই, পাটিসাপটা, মালপোয়া, ক্ষীরকুলি, তিলকুলি, ঝাল পিঠা, ফুলঝুরি ইত্যাদি। বাঙালির শৈল্পিক ঐতিহ্যের ধারক এই পিঠা শুধু শীতকালের মিষ্টি স্বাদ নয়, এটি বাঙালির জীবনে আনন্দ আর উচ্ছ্বাসের উৎস।প্রাচীন বাংলার ধানের মতোই পিঠারও ছিল অসংখ্য নাম। যদিও কালের বিবর্তনে অনেক পিঠা হারিয়ে গেছে, তবে অনেক পিঠা আজও জীবন্ত। পিঠা-পার্বণ কেবল উৎসব নয়, এটি বাঙালির জীবনের আনন্দঘন মুহূর্তের প্রতীক। হাজারো প্রতিকূলতা সত্ত্বেও পিঠা-পার্বণের ঐতিহ্য বাংলার ঘরে ঘরে টিকে আছে।
পিঠার মিষ্টি গন্ধে শীতের সকাল আর সন্ধ্যা ভরে উঠুক। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে পড়ুক বাঙালির এই চিরায়ত ঐতিহ্য। পিঠা-পার্বণের মধুময়তা বাংলার সংস্কৃতিকে আরও সমৃদ্ধ করে তুলুক।

Share on facebook
Share on whatsapp
Share on twitter
Share on linkedin
Share on print

আরও পড়ুন