৭ই জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

পৌষ সংক্রান্তির তাৎপর্য

বিপ্লব কান্তি নাথঃ

ঋতু বৈচিত্র্যের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে চলে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য। নানা ধর্ম-বর্ণের মিশেলে এ দেশের সংস্কৃতিতে এসেছে ভিন্ন ধারা। সেই আদিকাল থেকেই এই ধারায় একে অন্যের সঙ্গে মিলেমিশে বাস করে আসছে। আতিথেয়তায় এ দেশের মানুষের সুনাম বিশ্বজোড়া। আবার ভোজনরসিক হিসেবে পরিচিত।হাজার বছর ধরে বাঙালির ঘরে ঘরে এই সংস্কৃতি চলে আসছে পিঠা খাওয়ার উপযুক্ত সময় শীতকাল। পিঠার কথা উঠতেই বাংলা মুলুকে পৌষ-মাঘের কথা আসে। এ মাস এলেই সবাই যেন নষ্টালজিক হয়ে ওঠে। কারণ সেই আদিকাল থেকেই বাংলার প্রতিটি ঘরে পিঠা বানানোর কার্যক্রম চলে আসছে। অতিথি এলে চলে পিঠা দিয়ে তাদের আপ্যায়ন। ধনী-গরিব প্রতিটি ঘরে সাধ্যমতো পিঠা বানানোর তোড়জোড় চলে। এটা যতটা না খাওয়ার উৎসব তার থেকে বেশি অপরকে খাইয়ে আনন্দ পাওয়ার উৎসব। উৎসবের মতো করেই পিঠা খাওয়ার এই ব্যতিক্রমী আয়োজন যেন চলে আসছে জন্ম-জন্মান্তর ধরে।বাঙালির তেরো পার্বণের অন্যতম একটি পার্বণ বা উৎসব হল পৌষ সংক্রান্তি বা মকর সংক্রান্তি। এই সময়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে এই উৎসব পালিত হয়। এবছর ১৪ই জানুয়ারী ২০২৫খ্রী. ২৯ পৌষ১৪৩১ রোজ মঙ্গলবার পৌষ সংক্রান্তি এবং উত্তরায়ণ শুরু।এই পৌষ সংক্রান্তি উপলক্ষে প্রতি হিন্দু ঘরে ঘরে পালন করা হয় নানান নিয়মকানুন। এই পৌষ সংক্রান্তির উৎপত্তি কিভাবে? কেন পালন করা হয় এই পৌষ সংক্রান্তির নিয়ম ?পুরাণ মতে, এই পৌষ সংক্রান্তি বা মকর সংক্রান্তির বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। কথিত রয়েছে, এই মকর সংক্রান্তিতে সূর্য পুত্র শনিদেবকে নিয়ে নিজ বাড়িতে গমন করেন। এছাড়াও শোনা যায় মহাভারতের ভীষ্ম পিতামহ শরশয্যায় ইচ্ছামৃত্যু গ্রহণ করেছিলেন এই দিনেই। দেবতাদের সঙ্গে অসুরদের যে দ্বন্দ্ব চলছিল সেই দ্বন্দ্বের সমাপ্ত হয়েছিল এই মকর সংক্রান্তিতেই। অসুরদের বধ করে শুভ শক্তির সূচনা ঘটেছিল পৌষ সংক্রান্তিতেই। তাই এই সময় থেকে যেকোনো ধরনের শুভ কাজের সূচনা হয়ে থাকে। অত্যন্ত শুভ সময় বলা হয় মকর সংক্রান্তির সময়টাকে।পৌষ সংক্রান্তির উৎপত্তি : হিন্দু পঞ্জিকা মতে ‘সংক্রান্তি’ কথার অর্থ হল মাসের শেষ তারিখ। সেই অনুযায়ী পৌষ মাসের শেষ তারিখে পৌষ সংক্রান্তি পালন করা হয়। প্রতি বাড়িতেই নানারকম পিঠে-পুলি তৈরি করা হয়। অপরদিকে জ্যোতিষ শাস্ত্রে ‘সংক্রান্তি’ কথার অর্থ হলো বিচরণ করা। অর্থাৎ প্রতিমাসেই সূর্য গ্রহ বিভিন্ন রাশিতে গমন করে, সেই অনুযায়ী পৌষ সংক্রান্তির শেষে সূর্য গমন করে মকর রাশিতে। আর এই সময়টিকে মকর সংক্রান্তি বলা হয়। এদিন সূর্যের দক্ষিণায়ণ সমাপ্ত এবং উত্তরায়ণ পালিত হয়। শুভ কাজগুলি এই দিন থেকেই শুরু হয়।
মকর সংক্রান্তির নিয়ম-কানুন : শাস্ত্র মতে, মকর সংক্রান্তি বা পৌষ সংক্রান্তিতে হিন্দু ঘরে ঘরে নানা নিয়মমাচার পালন করা হয়। শুধু এই দিন নয়, মকর সংক্রান্তির আগে থেকেই গৃহ পরিষ্কার করা, শুদ্ধিকরণ করা শুরু করে বাঙালিরা। গ্রাম বাংলার হিন্দু বাড়িতে আলপনা আঁকা হয়। এদিন অনেকেই মিষ্টি, গুড় বিতরণ করে। প্রতি হিন্দু বাড়িতে লক্ষ্মী পূজা করা হয় এই মকর সংক্রান্তিতে।মকর সংক্রান্তির অন্যতম নিয়ম হলো পিঠে-পুলি করা। এই উৎসবটিকে পিঠে-পুলি উৎসব বলেও নামাঙ্কিত করা হয়। চালের গুড়ি, দুধ, নারকেল, গুড় প্রভৃতি উপকরণ দিয়ে নানা ধরনের পিঠে পায়েস তৈরি করে স্বাগত জানানো হয় নতুন মাসের।প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী মকর সংক্রান্তিতে কোথাও গিয়ে রাত থাকা উচিত নয় বলে বিবেচিত হয়। এমনকি দুর ভ্রমণেও যাওয়া অনুচিত। যদি কোথাও কেউ যায় তাহলে সেদিনই তাকে বাড়ি ফিরে আসতে হয়। মূলত এদিন অশুভ শক্তির বিদায় জানিয়ে শুভ শক্তির আগমন করা হয় প্রতি হিন্দু বাড়িতে।
সংক্রান্তি অর্থ সঞ্চার বা গমন করা। সূর্যাদির এক রাশি হতে অন্য রাশিতে গমন করাকেও সংক্রান্তি বলা হয়। সং+ ক্রান্তি অর্থ সঙ মানে সাজা ক্রান্তি সংক্রমন বা গমন করাকে বুঝায়। অর্থাৎ ভিন্ন রুপে সেজে অন্যত্র গমন করা বা সঞ্চার হওয়াকে বুঝায়। মাঘ, ফাল্গুন, চৈত্র, বৈশাখ, জৈষ্ঠ, আষাঢ় এই ছয় মাস উত্তরায়ণ কাল এবং শ্রাবন,ভাদ্র,আশ্বিন,কার্ত্তিক,অগ্রহায়ন, পৌষ, এই ছয় মাস দক্ষিনায়ন কাল। পৌষ মাসের শেষ দিনে সূর্য উত্তরায়নের দিকে যাত্রা শুরু করে বলে একে উত্তরায়ণ সংক্রান্তিও বলা হয়। শাস্ত্রমতে মানুষের একবছর দেবতাদের একটি দিন রাতের সমান। অর্থাৎ মানুষের উত্তরায়নের ছয়মাস দেবতাদের একটি দিন এবং মানুষের দক্ষিনায়ণের ছয়মাস দেবতাদের একটি রাত। রাতে মানুষ যেমন দড়জা জানালা, প্রধান ফটক বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়েন তেমনি দেবতাগনও রাত্রে অর্থাৎ দক্ষিনায়নে সবকিছু বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়েন। এসময় বাহির থেকে প্রবেশ করার সুযোগ নেই অর্থাৎ দক্ষিনায়নে দেবলোক পুরোপুরি বন্ধ থাকে। আবার দেবতাগনের রাত পৌষ সংক্রান্তির দিন শেষ হয় বলে পরবর্তি সূর্য উদয়ের ব্রহ্মমুহূর্ত থেকে দেবতাগনের দিবা শুরু হয়। উক্ত সময়ে স্বর্গবাসী ও দেবলোকের সকলের নিদ্রা ভঙ্গ হয় এবং নিত্য ভগবৎ সেবামূলক ক্রিয়াদী শুরু হতে থাকে। এই জন্য সনাতন ধর্মাম্বলম্বীগন ব্রহ্ম মুহূর্তে স্নান, নামযজ্ঞ, গীতাপাঠ, শঙ্খধ্বনি, উলুধ্বনি ও অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দিনটিকে আনন্দময় করে তুলেন।অন্যদিকে গঙ্গাপুত্র ভীষ্ম তাঁর পিতা শান্তনু থেকে বর পেয়েছিলেন যে তিনি যখন ইচ্ছা মৃত্যুবরন করতে পারবেন। মহাভারতের কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের বীশ্ববিখ্যাত বীর, মহাপ্রজ্ঞ, সর্বত্যাগী ও জীতেন্দ্রিয় মহাপুরুষ ভীষ্মের মহাপ্রয়ানের স্মৃতির জন্য পৌষ সংক্রান্তি আরও মর্যাদা পূর্ণ হয়েছে। উলেক্ষ্য কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে কৌরব পক্ষের চারজন সেনাপতির মধ্যে তিনিই প্রধান সেনাপতি ছিলেন। উভয় পক্ষের আঠার দিন যুদ্ধের দশম দিবসে সূর্যাস্তের কিছুক্ষন পূর্বে পান্ডব পক্ষের সেনাপতি অর্জুনের শরাঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে ভীষ্মদেব রথ থেকে পড়ে যানএ কিন্তু তিনি মাটি স্পর্ষ না করে আটান্নদিন তীক্ষè শরশয্যায় শুয়ে উত্তরায়নের উত্তরায়নের অপেক্ষা করে পৌষ সংক্রান্তির দিনে যোগবলে দেহত্যাগ করেন।গ্রাম বাংলা সহ ভারতের বিভিন্ন জায়গায় ভোরবেলা আগুন লাগানো হয় খর ও বাঁশ দিয়ে বানানো স্তুপে। এটা মূলত পিতামহ ভীষ্মদেবের চিতার স্বরুপ। পৌষ সংক্রান্তির দিন সূর্য উত্তর মেরুতে হেলে পড়তে থাকে যার জন্য একে মকর সংক্রান্তি বা উত্তরায়ণ সংক্রান্তি বলে। শাস্ত্রমতে ভীষ্মদেব মৃত্যুর পরে ভাগবদ্ ধামে যাননি। তিনি ছিলেন দৌ মতান্তরে দ্যু নামক অষ্টবসু। যিনি মহর্ষি বশিষ্টের অভিশাপ গ্রস্ত হয়ে ইহলোকে মনুষ্য হিসাবে কৃতকর্ম ভোগের জন্য জন্ম নিয়েছিলেন। তাই তাঁর পুনরায় দেবলোকে যাবার কথা। কারন তিনি সেখানকার স্থায়ী বাসিন্দা। দক্ষিনায়ণের সময়ে দেবলোকে রাত্রি,সেই সময় সেখানকার সব কিছুই বন্ধ থাকে,ভীষ্মদেব যদি দক্ষিনায়ণে দেহত্যাগ করতেন তবে তাঁকে তাঁর লোকে প্রবেশ করার জন্য বাইরে প্রতিক্ষা করতে হতো। তিনি ইচ্ছামৃত্যু বরন করেছিলেন বলে ভেবে দেখলেন, দক্ষিনায়ণে মহাপ্রয়ান করলে দেবলোকে গিয়ে বাইরে প্রতিক্ষা করার চেয়ে এখানে থেকে উত্তরায়নের প্রতিক্ষা করাই ভালো। কারন এখানে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের দর্শণ লাভ হবে এবং সৎসঙ্গ হতে থাকবে। যার ফলে সকলেরই মঙ্গল হবে। দেবলোকে একলা প্রতীক্ষা করে কী হবে। এই ভেবে তিনি দক্ষিনায়ণে শরীর ত্যাগ না করে উত্তরায়ণে শরীর ত্যাগ করেছিলেন। দীর্ঘ আটান্নদিন শরশয্যায় অবস্থানের পর পৌষ সংক্রান্তির নিশান্তে পিতামহ ভীষ্মদেব যোগবলে দেহত্যাগ করে দেবলোকে গমন করেন।৫০০০ বছর পূর্ব হইতে প্রতিবৎসর পৌষ সংক্রান্তি বা উত্তরায়ণে প্রাতকালে খরকুটো জড়ো করে পিতামহ ভীষ্মদেবের প্রতিকী শবদাহ করে থাকি, অনেকে এই শবদাহকে বুড়ির ঘরবামেড়ামেড়ির ঘর জ্বালানো বলে থাকেন এবং এই দিনে মাছ, মাংস আহার করে থাকেন যাহা সম্পূর্ণ অনুচিত। কারণ উত্তরায়ণ বা পৌষ সংক্রান্তি অন্তোষ্টিক্রিয়া ও শ্রাদ্ধ সংক্রান্ত অনুষ্ঠান। অন্যদিকে এই দিনটি এতই গুরুত্বপূর্ন যে, এই দিন প্রাতঃকালে দেবলোকের সকল দেবতাগন ও স্বর্গবাসী পূর্বপুরুষগন নিদ্রা থেকে জাগ্রত হন। এই জন্য সনাতন ধর্মাবলম্বীগন ব্রহ্মমুহূর্তে স্নান, শঙ্খধ্বনি, উলুধ্বনি, গ্রামে নগড়ে সংকীর্তন, গীতাপাঠ, ইত্যাদি মঙ্গলজনক কাজ করে থাকেন। প্রতিবৎসর শাস্ত্রসন্মতভাবে ভাবগাম্ভীর্যের সহিত এই অনুষ্ঠান পালন করার আশা ব্যক্ত করে সবাইকে মহা সংক্রান্তির প্রণাম, প্রীতি ও শুভেচ্ছা।

Share on facebook
Share on whatsapp
Share on twitter
Share on linkedin
Share on print

আরও পড়ুন