৭ই জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

শিব নারায়ণের নাম মুছতেই কি পতাকা থেকে মানচিত্র সরানো হয়?

রতন রায় অর্ঘ্যঃ

মহান মুক্তিযুদ্ধে যে পতাকা কোটি বাঙালির প্রেরণা ছিল, সেই পতাকা পরবর্তীতে কেন পরিবর্তন করা হলো? যে পতাকার মানচিত্রের আবেদন চিরকালই বাঙালির অন্তরতম গভীরতায় ছিল ও আছে তা কেন সরানো হলো? মানচিত্রে যদি আপত্তিই থাকে, তবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের জাতীয় মনোগ্রামে কেন সেই মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবহ লাল বৃত্তের মাঝে বাংলাদেশের হলুদ মানচিত্র রয়ে গেল? শিব নারায়ণ দাশ (১৬ ডিসেম্বর ১৯৪৬-১৯ এপ্রিল ২০২৪) বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় পতাকার অন্যতম এবং মূল নকশাকার। তিনি একজন ছাত্রনেতা ও স্বভাব আঁকিয়ে ছিলেন। ১৯৭০ সালের ৬ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলের (বর্তমান শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) ১১৬ নং কক্ষে রাত এগারটার পর পুরো পতাকার নকশা সম্পন্ন করেন। এ পতাকাই পরবর্তীতে ১৯৭১-এর ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় উত্তোলিত হয়।শিব নারায়ণ দাশের পিতা সতীশচন্দ্র দাশ। তিনি কুমিল্লাতে আয়ুর্বেদ চিকিৎসা করতেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পাক হানাদাররা তাকে ধরে নিয়ে হত্যা করে। শিব নারায়ণ দাশের মাতার নাম গীতশ্রী চৌধুরী এবং এক ভাই অর্ণব আদিত্য দাশ।শিব নারায়ণ দাশ প্রথম ভাষা সৈনিক ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের হাত ধরে রাজনীতিতে আসেন। ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন অংশগ্রহণ করে কারাবরণ করেছিলেন তিনি।১৯৭০ সালের ৭ জুন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকার পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত ছাত্রদের এক সামরিক কুচকাওয়াজে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অংশ গ্রহণের কথা ছিল। এই লক্ষ্যে ছাত্রদের নিয়ে একটি জয়বাংলা বাহিনী, মতান্তরে ‘ফেব্রুয়ারি ১৫ বাহিনী’ গঠন করা হয়। ছাত্র নেতারা এই বাহিনীর একটি পতাকা তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়।

এই লক্ষ্যে ১৯৭০ সালের ৬ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের (তৎকালীন ইকবাল হল) ১০৮ নং কক্ষে ছাত্রলীগ নেতা আ স ম আবদুর রব, শাহজাহান সিরাজ, কাজী আরেফ আহমদ, মার্শাল মনিরুল ইসলাম পতাকার পরিকল্পনা নিয়ে বৈঠকে বসেন। এ বৈঠকে আরো উপস্থিত ছিলেন ছাত্রলীগ নেতা স্বপন কুমার চৌধুরী, জগন্নাথ কলেজের ছাত্রলীগ নেতা নজরুল ইসলাম, কুমিল্লা জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় ছাত্রনেতা শিবনারায়ন দাশ, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ সাধারণ সাধারণ সম্পাদক হাসানুল হক ইনু ও ছাত্রনেতা ইউসুফ সালাউদ্দিন।সভায় কাজী আরেফের প্রাথমিক প্রস্তাবনার উপর ভিত্তি করে সবার আলোচনার শেষে সবুজ জমিনের উপর লাল সূর্যের মাঝে হলুদ রঙের বাংলার মানচিত্র খচিত পতাকা তৈরির সিদ্ধান্ত হয়। কামরুল আলম খান (খসরু) তখন ঢাকা নিউ মার্কেটের এক বিহারী দর্জির দোকান থেকে বড় এক টুকরো সবুজ কাপড়ের মাঝে লাল একটি বৃত্ত সেলাই করে আনলেন; এরপর প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের কায়েদে আজম হল (বর্তমানে তিতুমীর হল)-এর ৩১২ নং কক্ষের এনামুল হকের কাছ থেকে অ্যাটলাস নিয়ে ট্রেসিং পেপারে আঁকা হলো পূর্ব পাকিস্তানের মানচিত্র। শিব নারায়ণ দাশ পরিশেষে তার নিপুণ হাতে মানচিত্রটি আঁকলেন লাল বৃত্তের মাঝে, এমনি করে রচিত হলো ‘ফেব্রুয়ারি ১৫ বাহিনী’র পতাকা, যা কিছুদিন পর স্বীকৃত হয় বাংলাদেশের প্রথম পতাকা হিসেবে।৭ জুন ১৯৭০-এ অনুষ্ঠিত কুচকাওয়াজের নেতৃত্ব প্রদান করেন আ স ম আবদুর রব। অল্প পেছনে পতাকা হাতে অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন হাসানুল হক ইনু। রব সেই পতাকা বঙ্গবন্ধুর হাতে তুলে দেন এবং শেখ মুজিবুর রহমান সেই পতাকা ছাত্র-জনতার সামনে তুলে ধরেন। এরপর ইনু পতাকাটি তার কক্ষে নিয়ে যান এবং সহপাঠি শরীফ নুরুল আম্বিয়া শেরে বাংলা হলের ৪০৪ কক্ষের খবিরুজ্জামানকে পতাকাটি বাক্সে লুকিয়ে রাখতে বলেন। এরপর একাত্তরের শুরুতে নগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ জাহিদ হোসেন পতাকাটি নিয়ে যান তার মালিবাগের বাসায়।১৯৭১ এর ২ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত হবার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় এক বিশাল সমাবেশ হয়। এ সমাবেশে আ স ম আবদুর রব যখন বক্তৃতা করছিলেন, তখন নগর ছাত্রলীগ নেতা শেখ জাহিদ হোসেন একটি বাঁশের মাথায় পতাকা বেঁধে রোকেয়া হলের দিক থেকে মঞ্চস্থলে মিছিল নিয়ে এগিয়ে আসেন। রব তখন সেই পতাকা উত্তোলন করেন। এটাই আমাদের জাতীয় পতাকা উত্তোলন দিবস।১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবসে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানের জাতীয় পতাকার পরিবর্তে শিব নারায়ণ দাশের নকশা করা বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়।একাত্তরের রণাঙ্গণে অকুতোভয় সৈনিক ছিলেন শিবু। অথচ মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতিটুকুও পাননি তিনি। তার চিকিৎসক পিতাকে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তুলে নিয়ে হত্যা করা হলেও তাকে কখনো ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী’ কিংবা স্রেফ ‘শহীদ’ হিসেবেও স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি।১৯৭২ সালে সরকার শিব নারায়ণ দাশের নকশাকৃত পতাকার মাঝে মানচিত্রটি বাদ দিয়ে পতাকার মাপ, রঙ, ও তার ব্যাখ্যা সংবলিত একটি প্রতিবেদন দিতে বলে পটুয়া কামরুল হাসানকে। অর্থাৎ পরিকল্পনাটা সরকারেরই ছিল। সেই মোতাবেক কামরুল হাসান কর্তৃক পরিমার্জিত রূপটিই বর্তমানে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা।শিবনারায়ণের মতো একজন সংগ্রামী ছাত্রলীগ নেতা ও বীর মুক্তিযোদ্ধার নাম জাতীয় পতাকার নকশাকার হিসেবে রইবে না। পাঠ্যপুস্তকে তার নাম পড়বে না কেউ। সরকারি নির্দেশে স্রেফ মানচিত্রটা সরিয়ে দিয়ে নকশাকারের ফুল ক্রেডিট দেওয়া হলো কামরুল হাসানকে। আচ্ছা, এই নির্দেশ তো শিব নারায়ণ দাশকেও দেওয়া যেত, তাই না? মূল নকশাকার হিসেবে তারই এই নির্দেশপ্রাপ্তি অধিকতর যুক্তিযুক্ত ছিল কি না?শেষ জীবনে প্রচণ্ড অভিমানে নিভৃতচারী ছিলেন শিব নারায়ণ দাশ। এমনকি শ্বাসকষ্টে ভুগলেও সুচিকিৎসার জন্য যথেষ্ট স্বচ্ছল ছিলেন না। থাকতেন মেয়ের ভাড়াকৃত বাসায়। সব অভিমান সাথে নিয়ে ১৯ এপ্রিল, ২০২৪ তারিখে ঢাকার একটি হাসপাতালে ৭৮ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন শিব নারায়ণ দাশ (ওঁ দিব্যান্ লোকান্ স গচ্ছতু)। এই সংগ্রামী নেতা ও মুক্তিযোদ্ধার বিদেহী আত্মার সদ্গতি ও শান্তি প্রার্থনা করি। তাঁকে ও সকল ত্যাগী বীর মুক্তিযোদ্ধাকে বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই।

Share on facebook
Share on whatsapp
Share on twitter
Share on linkedin
Share on print

আরও পড়ুন